রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৫ অপরাহ্ন
কালের খবর : বাংলাদেশের মানুষ এভাবেই ইংরেজি বছরের দুটি মাসকে চিহ্নিত করেছে, প্রধানত এদের গুরুত্ব এবং অভিঘাত অনুধাবনের জন্য; দ্বিতীয়ত, মাসজুড়ে এদের নানা দিক ও বৈশিষ্ট উদযাপনের জন্য। ফেব্রুয়ারি শোকের মাস আমরা শোকটা গভীরভাবে অনুভব করি; কিন্তু ভাষার শক্তি, যে শক্তি সংস্কৃতিকে জাগায়, তার উদযাপন করি। মার্চেও শোকে কালো ছায়া আছে। একাত্তরের সারা মার্চজুড়ে বাঙ্গালি প্রাণ বিলিয়েছে স্বাধীনতার জন্য। ২৫ মার্চের রাতে হাজার হাজার বাঙ্গালিকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। কিন্তু এসব অমূল্য জীবনের বিনিময়ে ২৬ মার্চ আমরা স্বাধীন হলাম। আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। এর ফলে পুরো একাত্তর জুড়ে আমাদের যুদ্ধের চরিত্রটি নির্দিষ্ট হয়ে গেল। আমরা এক স্বাধীন জাতি, আমাদের দেশ থেকে দখলদার এক বর্বর বাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নামলাম। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ একটি পরাধীন জাতির স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ ছিল না, ছিল এক স্বাধীন জাতির স্বাধীনতাকে নিষ্কন্টক করার যুদ্ধ। এজন্য ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর নয়। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। বর্বর সেই দলখদার বাহিনীকে পরাস্ত করে আমাদের বিজয় আমরা সেদিন নিশ্চিত করেছিলাম।
তবে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চকে বাংলাদেশের মানুষ যতটা ভাষার ও স্বাধীনতার মাস হিসেবে চিহ্নিত করল, তার চেয়ে বেশি করল ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি যে ভাষা আন্দোলন হল-বলা যায় ভাষা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় আমরা অতিক্রম করলাম, তা আমাদের জাগিয়ে দিল। ভাষার প্রশ্নে, সংস্কৃতির প্রশ্নে আমরা একতাবদ্ধ হলাম। আমরা আত্মসচেতন হলাম, আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ল এবং সংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দীর্ঘ এক সংগ্রামে নামলাম। সেই পথটা অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে ১৯৭১ এর মার্চ মাসে পৌঁছে দিল। মার্চের ২৫ তারিখ মধ্যরাত থেকে শুরু হলো স্বাধীনতার সংগ্রামের এক সশস্ত্র অধ্যায়। আমাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ছিল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে। এই বাহিনীর দুর্ধর্ষ এবং আত্মঘোষিত অজেয় পান্ডারা ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মাথা নিচু করে আত্মসমর্পন করল। দুর্বৃত্তরা এভাবেই তাদের সব অহংকারকে ধুলোয় মিশে যেতে দেখল।
কিন্তু ভাষার মাসে যেমন ভাষার বিজয় যে সবদিক দিয়ে সুনিশ্চিত হয়ে গেল, তা নয়, স্বাধীনতার মাসেও তেমনি। ভাষার শত্রুরা এখনো আছে, এখনো তারা সক্রিয় বাংলা ভাষাকে দুর্বল করতে, ইংরেজির হাতে তুলে দিতে। স্বাধীনতার শত্রুরাও তেমনি আছে। এদের মধ্যে আছে একাত্তরের পরাজিত পক্ষ, যারা বাঙ্গালির যুদ্ধে বাঙ্গালি হয়েও প্রতিপক্ষের অবস্থানে ছিল। আরও আছে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনুসারীরা। এদের সঙ্গে আরও আছে কিছু বিভ্রান্ত মানুষ, যরা ভাবে পাকিস্তানে ইসলাম নিরাপদ, আর পাকিস্তানই ভালো ছিল। পাকিস্তানে ইসলাম যে কতটা নিরাপদ তাতো আমরা দেখছি-শুক্রবার এলেই অনেকে সেদেশে ভয়ে থাকেন; কোন মসিজিদে না আবার বোমা বিস্ফোরণে মানুষ মরে।
বাংলাদেশে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভাল নেই-আমাদের স্বাক্ষরতা শতভাগে পৌঁছেনি; দারিদ্র এখনো প্রকট; দুর্নীতি এখনো দু;সহনীয়; নিত্যপণ্যের দাম এখনো অনেক মানুষের নাগালের বাইরে; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নাজুক। এখনো মানুষ গুম খুনের আতঙ্কে থাকে, বিরোধী দলের- বিশেষ করে বিএনপির- নেতাকর্মীরা এখনো ধর পাকড়ের খড়গ মাথায় নিলে চলেন। কিন্তু দেশটি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বেশির ভাগ সূচকেই। ইসলাম এ দেশে নিরাপদ নয়, দেশটির বড় সমালোচকও তা বলবেন না। গত বিজয় দিবসে পাকিস্তানে ডন পত্রিকা এক উপ-সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে প্রশংসা করেছে-নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এর এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টির।
ভাষার মাসে ভাষার শত্রুদের সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম, এদের প্রতিহত করার প্রয়োজন নেই, বরং বাংলা ভাষাকে শিক্ষার সকল স্তরে গুরুত্ব দিয়ে, ভাষাশিক্ষার আধুনিক পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে, ভাষা ব্যবহারের বৃত্তটি সম্প্রসারিত করে এর ব্যাবহারটিকে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া দিয়ে কার্যকর করে আমরা যদি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ এবং সম্ভাবনার উচ্চতম স্তরে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে যারা বাংলা ভাষাকে হেলাফেলা করেন, এর বিকৃতি ঘটিয়ে আনন্দ পান-তারাও এর মুগ্ধ ব্যবহারকারীতে পরিণত হবেন।
সেরকম, স্বাধীনতার মাসেও আমি বলি, কারা বাংলাদেশে শত্রু কারা এর বিকল্প খোঁজে পাকিস্তান বা অন্যত্র, সেই প্রশ্নে না গিয়ে আমরা যদি বাংলাদেশকে সত্যিকার এক উন্নত দেশ হিসেবে গড়ি তুলতে পারি-যেখানে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন কার্যকর: যেখানে দারিদ্র, অস্বাস্থ্য এবং অপুষ্ঠি নেই: যেখানে সবাই শিক্ষিত এবং যেখানে যেখানে সকলের জন্যই কর্মসংস্থান রয়েছে,; যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণগত বৈষম্য নেই-সকালের রয়েছে সমান অধিকার, তাহলে বাংলাদেশকে এখনো যারা মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি, তারাও প্রাণের আবেগে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবে। আমি ভাষার বিরুদ্ধাচারী ৫-৭ শতাংশ অথবা স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারী ৫-৭ শতাংশের জন্য চিন্তিত নই (এই পরিসংখ্যানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাম ছাত্রসংগঠনের লিফলেটে দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে। তবে আমার ধারণা এই সংখ্যা আরো কম)। আমি চিন্তিত সিংহভাগ নিয়ে। যদি ৩০ শাতংশ মানুষ মাতৃভাষায় লিখতে বা পড়তে না পারেন, তাহলে ভাষা নিয়ে আমাদের অহংকারটা কোথায় থাকে? আর যদি স্বাধীনতার সুফল-ওপরে যেগুলোর একটা সারাংশ করেছি-যদি শতভাগ মানুষের হাতে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে স্বাধীনতাটা কি সকলের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে বলে আমরা দাবি করতে পারি?
২. স্বাধীনতার মাসের একেবারে শুরুতে তাই আমাদের প্রয়োজন স্বাধীনতা শব্দটির নানা অর্থ, গুরুত্ব ও অভিঘাতকে বিবেচনায় নিয়ে একটি উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করা এবং সেই রাস্তায় নিরলস এগিয়ে যাওয়া। গত দুই দশকে বাংলাদেশ চমৎকার অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। এখন এই সমৃদ্ধির হার আরো বাড়িয়ে এর সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন অর্জন করতে পারলেই আমরা একসময় বলতে পারব, আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ হয়েছে, এর সুফল দেশের সকল জনগোষ্ঠি-প্রান্তিক, আদিবাসীসহ সকল জনগোষ্ঠি ভোগ করছে।
প্রথমেই দেখতে হবে, আমাদের উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে কিনা। সেজন্য প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা, দুর্নীতি নির্মূল করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এসব অনেক কম পরিশ্রমে করা যায় দেশে গণতন্ত্রের চর্চা অবারিত করলে। আমরা চাই দেশে গণতন্ত্র শিকড় বিস্তার করুক। এজন্য সরকারি দলকে উদ্যোগটা জোরালোভাবে নিতে হবে। সকল দলের অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। বিরোধী দল গুলির বিশেষ করে বিএনপিরও এক্ষত্রে দায়িত্ব আছে। একাত্তর সাল সম্পর্কে দলটির ভূমিকা স্পষ্ট করতে হবে, বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতা সম্পর্কেও দলটির চিন্তায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। একাত্তরের চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করলে রাজনীতির মাঠ সমান করায় দলটির দাবি উপেক্ষিত হবে এবং মানুষের সমর্থনও তা পাবে না। অথচ বিএনপি ছাড়া জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যাবে।
স্বাধীনতার মাসে সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের, সরকারের এবং সমাজের দায়বদ্ধতা দৃঢ় করতে হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি বিলাইছড়িতে যে দুই মারমা তরুণী ধর্ষণের শিকার হলেন, তার পুণরাবৃত্তি কোনোকালেই যাতে না ঘটে তার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে। এরকম অপরাধের শাস্তিও শুধু আশ্বাসে থাকলে চলবে না। কাজে তার প্রমাণ থাকতে হবে।
শিক্ষার বিস্তার যেন ঘটে এবং শিক্ষার মান যেন বাড়ে সে ব্যাপারে সরকারকে সফল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংস্কৃতি এবং সুস্থ জীবনচর্চার সহযোগী সকল পদক্ষেপ রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সর্বোপরি সকলের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পরিবেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তালিকাটি আরও বড় করা যায়, কিন্তু তালিকায় যত কর্মযজ্ঞ সংযোজিত হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা এবং সংকল্প না থাকলে এর কোনোটির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
আমরা চাই স্বাধীনতার মাসে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য যত উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন, তা নিতে হবে, এরকম একটি প্রতীজ্ঞা রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ এবং সকল প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে।